আমার দাদা- দাদী ও দাদার পারিবারিক বৃত্তান্ত

আমার দাদাজান | আলহাজ্ব জয়নাল আবেদীন | ওরফে ধনী মিয়া

দাদাজান খুব নিরীহ সজ্জন মিতব্যয়ী সদালাপী মানুষ ছিলেন। জমি-জমা আর বিষয় সম্পত্তি ছিলো তার সব সময়ের ধ্যান- জ্ঞান। চাষাবাদ আর পশুপালন বিষয়ে ছিলো তার অগাধ বিদ্যা। তিনি সেসব কাজে লাগিয়ে কামিয়াবও হয়েছিলেন জীবনে।

বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান, বড় আদরে আহ্লাদে মানুষ। যদ্দুর জানা যায়, ৮ম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে তিনি হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক মাস পরে তিনি যখন ফিরলেন, তখন তিনি বৃটিশ আর্মির একজন সদস্য। কিন্তু তার মা মানে আমার প্র-পিতামহী জনাবা সুরুজ্জান বিবি ছেলেকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে রাজী হননি। শুনেছি, ছেলে পালিয়ে যেতে পারে এই ভেবে তিনি রাতেও জেগে কাটাতেন। প্র-পিতামহীর চাপে আমার প্র-পিতামহ জনাব আবদুল আজিজ ওরফে সোনা মিয়া তাঁকে আর বাড়ি ছাড়ার অনুমতি দেননি। ফলে দাদাজানের চাকুরী, এবং সেইসাথে লেখাপড়ারও সেখানেই ইতি ঘটলো।

এরপর দাদাজানের জীবন ধীরে ধীরে সাংসারিক কাজকর্মের মধ্যে জড়িয়ে গেলো। জমি জমা ইত্যাদি নিয়েই চলতে লাগলো তার কাজ কারবার। সেই থেকে দাদাজান পুরোপুরি সংসারী মানুষ। নিজে খেটে, অন্যদের খাটিয়ে তিনি সংসারের উন্নতিও করেছেন ঢের। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির পর নিজেও অর্জন করেছেন অনেক জমি-জমা।

আমার দাদাজান প্রথম জীবনে খুব সামাজিক মানুষ ছিলেন। সবার সাথে মিশতেন, আড্ডা দিতেন, যাত্রা পালা দেখতে যেতেন পড়শী বন্ধুদের নিয়ে।

কিন্তু, তারপর, আমার বয়স যখন পনের ষোল, তখন থেকে দেখেছি, দাদাজান আস্তে আস্তে বাইরের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন। তখন তিনি পুরোপুরি সংসারী। নিজের সংসার, জমি-জমা, গরু ছাগল, গাছপালা ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত তিনি সারাক্ষণ। বাজারে যান, বেচা-কেনা করেন, চলে আসেন। শেষ বয়স পর্যন্ত দাদাজানকে এমনই দেখেছি।

দাদাজান ধার্মিক মানুষ ছিলেন। নিয়মিত নামাজ রোযা করতেন। ১৯৯৭ সালে তিনি হজ্জ্ব পালন করেন।

দাদাজান অতিথি আপ্যায়নে খুব আন্তরিক ছিলেন। দান খয়রাতেও তাঁর ছিলো উদার হস্ত। মাদ্রাসার গরীব ছাত্রদের জন্য তিনি দান করতেন। আমাদের বিশাল কাঁঠাল বাগানের অনেকগুলো গাছ তিনি গরীব মিসকিনদের জন্য বরাদ্দ করে রাখতেন। বাড়ির কেউ সেসব গাছ থেকে কাঁটাল পেড়ে ফেললে তিনি বকাঝকা করতেন।

দাদাজান মানুষকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলতেন, এবং অনেক সময় তিনি ঠকতেন। কিন্তু বিশ্বাস করে যে তিনি ঠকেছেন এই কথাটা তাকে কিছুতেই বুঝানো যেতো না। সত্যিকার অর্থেই দাদাজান ছিলেন নরোম মনের মানুষ।

কিন্তু শেষ বয়েসে দাদাজানের মেজাজ কেমন রুক্ষ হয়ে গিয়েছিলো। কারনে অকারনে রাগারাগি করতেন, দাদীজানের উপর মেজাজ দেখাতেন। ছেলেদের বকাঝকা করতেন। তাঁর জমি-জমা বিষয় সম্পত্তি তাঁর ছেলেরা না নষ্ট করে ফেলে এই ভয়ে তিনি সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন থাকতেন।

দাদাজানের সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তাঁর কথা লিখতে গিয়ে সেসব স্মৃতি খুব মনে পড়ছে। একটা ঘটনা বলছি। ২০০১ সালের দিকে দাদাজানের চোখে ছানি পড়েছিলো। সেটা অপারেশনের জন্য আমি তাকে ঢাকার ইসলামিয়া হাসপতালে নিয়ে এসেছি। দুদিন পর ডাক্তার অপারেশন করলো। চশমা দিলো। চশমা আমি কেনো এতো দাম দিয়ে কিনলাম, আর এতো টাকার ঔষধ কেনো কিনলাম তা নিয়ে আমার সাথে সে কী রাগ! আমাকে ফেলেই তিনি ব্যন্ডেজ বাধা চোখ নিয়ে ছুটে চললেন আর হঠাৎ মিরপুরগামী একটা প্রায় চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন। এই হচ্ছে আমার দাদাজান।

২০০৬ সালে আমার দাদাজান ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর মৃত্যুর সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। তাঁকে শেষবার দেখেছিলাম তাঁর মৃত্যুর দিন সতেক আগে। অনেকদিন ধরেই অসুস্থ্য ছিলেন। অমন হঠাৎ করে যে দাদাজান চলে যাবেন আমি ভাবতেই পারিরি।
দাদাজানের স্মৃতি প্রায়ই আমাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে রাখে।

0 comments:

© Imon Reza একজন বোকাসোকা সাধারণ মানুষ, founder of nondon 2009

Back to TOP